তদন্ত রিপোর্ট ডেস্ক: বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তোপের মুখে পরে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। গেলো ১৫ বছর ধরে সিলেটে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের যারা চোরাচালান সিন্ডিকেট চালাতেন তারাও এখন অন্তরালে। আর সিন্ডিকেটের সেই ফাঁকা জায়গার দখল নিয়েছে। সিলেট জেলা যুবদল নেতা পরিচয়দানকারী এক চোরাকারবারি। এই পরিচয়ে গেলো ৫ আগস্টের পর গত ১০ মাসে প্রায় কয়েক কোটি টাকার মালিক বনেছেন। সিলেটের বিশ্বনাথের খাজাঞ্চি ইউনিয়নে বাসিন্দা হলেও নগরের উপশহের তাহার বাসস্থান। চোরাচালান পাচার করে তিনি কিনেছেন ফ্ল্যাট, গাড়ি। বনেছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক।
তিনি সিলেটের চোরাচালানের নিয়ন্ত্রক। নাম তার সুমন আহমদ। তার শরীরে অনেক ট্যাটু অংকিত, তাই অনেকেই তাকে টেটু সুমন বলে ডাকে। ভারতীয় কসমেটিক্স, চকলেট, ক্রীম, চিনিসহ নানান অবৈধ চোরাচালানের পণ্য এবং সোনা পাচার করে আজ সিলেটের চোরাচালানের ‘মুকুটহীন সম্রাট’।
জেলা যুবদল নেতা পরিচয়দানকারী এই সুমন গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, হরিপুরের চোরাকারবারীদের কাছে পরিচয় দিয়ে থাকেন সিলেট মহানগর বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক রেজাউল করিম নাচনের কাছের লোক! এই পরিয়চয়ে আজ সে এই রাজ্যের সম্রাট।
সিলেটে প্রশাসন চোরাচালানকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে চাইছে। সেই জন্য চতুর্মুখী অভিযান পরিচালনা করছে তারা। কিন্তু এসব অভিযানের ফাঁকে সুমন আহমদের নিয়ন্ত্রনে ফের সক্রিয় হয়েছে চোরাই সিন্ডিকেট। রুটও বদল করা হয়েছে। সে প্রশাসনের অসাধু অনেককেই ‘ম্যানেজ’ করে চোরাচালান পাচার করছে। প্রশাসনের কেউ সুমন আহমদের কথায় ম্যানেজ না হলে তাকে চাকরিচুত্য করারও রেকর্ড রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে টিলাগড়ের সারোয়ার, আকাশ, মাবরুল, সাদিক, নাজমুল ও সুমন আহমদ সোনা চোরাচালানের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করতো। সরকার বদলের পর সে তার এই কাজ যুবদলের নাম ভাঙিয়ে সুমন একাই নিয়ন্ত্রন করছে। তার এই কাজের জন্য সিলেট মহানগর ও জেলা যুবদলের পদধারী কয়েকজন নেতা ও সিলেটের টিভি এবং প্রিন্ট মিডিয়ার কিছু অসাধু সিনিয়র সাংবাদিককে টাকার বিনিময়ে কিনে রেখেছে। তাদের সে নিয়মিত বখরাও দেয়। তার কথায় এসব সাংবাদিকরা ঢালাও ভাবে সংবাদ প্রকাশ করে। এছাড়াও সিলেট জেলা ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার সাথে তার রয়েছে সখ্যতা। সে প্রতি রাতে তার সিন্ডিকেটের লোকদের নিয়ে বের হয় তার এই কাজে এবং সকালে কাজ ডেলিভারি দেয়ার বাড়ি ফিরে।
সিলেটের চোরাই রাজ্য বলে খ্যাত হরিপুর। ৫ আগস্টের পর সুমন এই রাজ্যে প্রায় কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রেখেছে। একটি কালো রংয়ের নিশান পাজেরো জীপে (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-১০৩১) এ করে কয়েকজন পদধারী যুবদল নেতা ও সাংবাদিকদের নিয়ে প্রতি রাতে নগদ কয়েক লাখ টাকা নিয়ে হরিপুর এবং কানাইঘাট সড়কে তার আসা যাওয়া। অনেক সময় এই জীপ দিয়ে প্রটোকল দিয়ে চিনির চোরাচালানের গাড়ি নগরীর কালিঘাটের জনৈক ব্যবসায়ী হোসেনের গোডাউনে সে নিজেই নিয়ে আসে।
ঈদের আগে সেনাবাহিনীর অভিযানে এই রাজ্য এখন অস্তিত্ব সংকটে। চিহ্নিত চোরাকারবারিরা পালিয়েছে এলাকা ছেড়ে। কেউ কেউ দেশ ছেড়েও পালিয়ে গেছে। এই অবস্থায় টেটু সুমন হাল ধরেছে এই রাজ্যের। তার নির্দেশে রুট পরিবর্তন করে ফের সক্রিয় হয়েছে হরিপুরের চোরাকারবারিরা। তাদের অনেকেই এখন জৈন্তাপুরের পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাটে অবস্থান নিয়েছেন। সেখানে থেকেই তারা চোরাচালান করছে।
গোয়াইনঘাটের সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজন জানিয়েছেন- উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে চোরাই মালামাল। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঢাকার ব্যবসায়ীদের জন্য কসমেটিক্স চকলেট, ক্রীম, চিনিসহ নানান পণ্য। এসব পণ্য দীর্ঘদিন ধরে হরিপুরের ব্যবসায়ীরা ক্যারিয়ার হিসেবে পৌঁছে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
হরিপুরে সেনাবাহিনীর অভিযানের পর মালামাল আটক হওয়ায় কিছু দিন চোরাচালান বন্ধ ছিল। ওই সময় প্রাণ ভয়ে হরিপুরের ব্যবসায়ীরা সিলেট থেকে পালিয়ে যান। সম্প্রতি তারা ফিরেছেন সিলেটে। সেনাবাহিনীর মামলা হওয়ার কারণে তারা বর্তমানে বেশির ভাগই অবস্থান নিয়েছেন গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি, হাদারপাড়, মাতুরতল, হাজীপুর, জাফলংসহ কয়েকটি এলাকায়। সেখান থেকে তারা চোরাই পণ্য রিসিভ সুমনের লোকদের মাধ্যমে ডিআই ট্রাকযোগে ঢাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছে।
হরিপুর চোরাই রাজ্যের পতন হওয়ার কারণে গ্রেফতার এড়াতে হরিপুরের অনেক ব্যবসায়ী কানাইঘাটে অবস্থান নিয়েছে। তারা লালাখাল সীমান্ত, কালীবাড়ী-বাদশাবাজার সীমান্ত ও লোভা সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে কসমেটিক্স সহ নানা পণ্য নিয়ে আসে। পরে সেই সব চালান সুমন বাহিনীর মাধ্যমে বোরহান উদ্দিন রুট দিয়ে পণ্য নিয়ে আসেন সিলেট নগরীর টুলটিকর এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায়। সেখান থেকে বড় ট্রাকে করে চোরাই পণ্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেয় বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। সূত্রটি আরো জানায়, সুমন আহমদের রয়েছে বিশাল লাইনম্যান নেটওয়ার্ক। এই রুটের প্রতিটি পয়েন্টে-পয়েন্টে তাদের অবস্থান। সুমন আহমদের মোবাইল কল লিস্ট পর্যবেক্ষণ করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এর সত্যতাও পাবে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে নাচন গ্রুপের এক নেতা জানান, সুমন আহমদ এক সময়ে নাচন গ্রুপ করতো। তার কোনো দলীয় পদ নেই। সিলেট মহানগর বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক রেজাউল করিম নাচন বর্তমানে প্রবাসে বসবাস করছেন। বিষয়টি তিনি জানেন না। তিনি এ বিষয়ে জানলে সুমনের পিঠের চামড়া তুলে ফেলবেন। তিনি ক্লিন ইমেজের নেতা।
এ ব্যাপারে সুমন আহমদের মোবাইল ফোনে কল করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
জৈন্তাপুর মডেল থানার ওসি আবুল বাশার মো. বদরুজ্জামান জানিয়েছেন- সীমান্তের অতি নিকটে বাজার হওয়ার পরে পুলিশ অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে। তবে সীমান্তের বিষয়টি অন্যান্য বাহিনীও দেখভাল করছে। তথ্যসুত্র:-sylhetpress.net
Leave a Reply